একটি শিশুর জন্ম নিজ দেশকে, বিশ্বকে আইনগতভাবে জানান দেয়ার একমাত্র পথ জন্মের পর জন্মনিবন্ধন করা। নবজাতকের একটি নাম ও একটি জাতীয়তা নিশ্চিত করতে এটি হচ্ছে প্রথম আইনগত ধাপ।
জন্ম নিবন্ধন প্রতিটি শিশুসহ বয়স্কদেরও একটি অধিকার। এটি নাগরিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। মূলত, পৃথিবীতে একটি শিশু জন্মানোর পর রাষ্ট্র থেকে প্রথম যে স্বীকৃতি সে পায় সেটি হলো জন্ম নিবন্ধন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ভোটার আইডি কার্ডের আবেদন, পাসপোর্ট আবেদন, ব্যাংকের কার্যক্রম, চাকরির নিয়োগ সহ প্রায় ১৯ টি ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধনের প্রয়োজন হয়ে থাকে।
আর যাদের ভোটার আইডি কার্ড নেই তাদের প্রায় সকল কাজেই জন্ম নিবন্ধন এর দরকার হয়। সেজন্য জন্ম নিবন্ধন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ডকুমেন্ট তবে অনেক সময় দেখা যায় আমরা ভুলবশত জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে ফেলি।
তবে চিন্তার কোন কারণ নেই কারণ আমরা কিছু উপায় এর মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন আবার ফিরে পেতে পারি। আর আজকে আমরা জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে গেলে কি করনীয় সেই সম্পর্কে আলোচনা করব।
জন্ম নিবন্ধন নম্বর বের করার উপায়
যদি আপনার কাছে হারিয়ে যাওয়া জন্ম নিবন্ধন এর ফটোকপি থাকে তাহলে আপনি খুব সহজেই হারিয়ে যাওয়া জন্ম নিবন্ধন পুনঃমুদ্রণ করার জন্য আবেদন করতে পারবেন তাই আপনাকে যত দ্রুত সম্ভব সেই ফটোকপিটি সংগ্রহ করতে হবে। আর যদি ফটোকপি না থাকে তবে কি করতে হবে তা আমরা আলোচনা থেকে জানব।
জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে গেলে আমাদের কে প্রথম যা করতে হবে তা হলো–
- অনলাইনে জন্ম সনদ যাচাই: আমাদের মধ্যে অনেকের জন্ম নিবন্ধন হাতে লেখা রয়েছে সেক্ষেত্রে প্রথমে সরকারের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ওয়েবসাইট থেকে জন্ম নিবন্ধন নাম্বার ও তারিখ ব্যবহার করে জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে আছে কিনা সেটি চেক করে নিতে হবে। যদি জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে না পাওয়া যায় তবে নতুন করে আবার নিবন্ধন করাতে হবে।
- নিবন্ধক কার্যালয় ভিজিট: যদি আপনার জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে থাকে তবে জন্ম নিবন্ধন পূনঃমুদ্রণ আবেদন করার জন্য আপনাকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন (অতীতে যেখান থেকে নিবন্ধন করেছিলেন) সেখানে গিয়ে যোগাযোগ করতে হবে।
জন্ম নিবন্ধনের অনলাইন যাচাই কপি ডাউনলোড
যদি আপনার জন্ম নিবন্ধন অনলাইন হয়ে থাকে তবে নতুন জন্ম নিবন্ধনের জন্য নিবন্ধনটি পূনঃমুদ্রণ আবেদন করতে হবে।বর্তমানের নতুন নিয়মের জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ পূনঃমুদ্রণ আবেদনের জন্য নিবন্ধক অফিসে যেতে হয়ে পূর্বে এই আবেদন অনলাইনের মাধ্যমে করা যেত।
এক্ষেত্রে নিকটস্থ ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভায় আপনার বাবা ও মায়ের জন্ম সনদ, আপনার হারানো জন্ম সনদের ফটোকপি (যদি থাকে, না থাকলে শুধু জন্মনিবন্ধনের নাম্বার) নিয়ে সরাসরি উপস্থিত হতে হবে।
অনলাইন থেকে জন্ম নিবন্ধন যাচাই করার জন্য আমাদেরকে ১৭ ডিজিটের জন্ম নিবন্ধন নম্বর ও জন্ম তারিখের প্রয়োজন রয়েছে। তবে যাদের কাছে জন্মনিবন্ধনের নাম্বার নেই তাদেরকে প্রথমে জন্ম নিবন্ধনের নাম্বার বের করতে হবে।
হারানো জন্ম নিবন্ধন নাম্বার বের করার জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে যা নিচে আলোচনা করা হলো –
ভোটার আইডি কার্ডের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন নাম্বার বের করা
১. ওয়েবসাইটে প্রবেশ: প্রথমে আমাদেরকে জাতীয় পরিচয় পত্রের যে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট রয়েছে সেখানে প্রবেশ করতে হবে।
২. রেজিস্ট্রেশন: আপনার একাউন্ট থাকলে লগইন করুন না থাকলে ‘রেজিস্ট্রিার করুন’ বাটনে ক্লিক করে একটি একাউন্ট খুলে নিন।
৩. তথ্য প্রদান: ভোটার আইডি কার্ডের নাম্বার ও জন্মতারিখ সঠিকভাবে লিখে ‘সাবমিট’ বাটনে ক্লিক করুন।
৪.ঠিকানা প্রদান: আপনার স্থানীয় ও বর্তমানের যে ঠিকানা রয়েছে ঠিকানা গুলো লিখুন।
৫.OTP: এবার OTP(One time password) পাঠানোর জন্য আপনাকে একটি মোবাইল নাম্বার দেখাবে যদি সেই নাম্বার আপনার কাছে থাকে তবে ‘বার্তা পাঠান’ বাটনে ক্লিক করুন। আর যদি ফোন নাম্বারটি না থাকে তাহলে ‘মোবাইল নাম্বার পরিবর্তন’ বাটনে ক্লিক করে OTP পাওয়ার জন্য আপনি আপনার নাম্বার পরিবর্তন করে দিতে পারবেন। অতঃপর OTP মোবাইলে আসার পর কোডটি বসিয়ে দিন।
৬.NID Wallet App Install ও রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন: যদি পূর্ব থেকে একাউন্ট থাকে তবে সেখানে ‘বহাল’ লেখা থাকবে সেখানে ক্লিক করতে হবে। অতঃপর প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য NID Wallet অ্যাপস ওপেন করে ফেস স্কিন করতে বলা হবে। ফেস স্কিন করার জন্য ব্রাউজারটি মিনিমাইজ করে গুগল প্লে স্টোরে গিয়ে NID Wallet অ্যাপ ইন্সটল করতে হবে।
তারপর পুনরায় এই ব্রাউজারে গিয়ে “Tap To Open NID Wallet” বাটন ক্লিক করতে হবে বাটন ক্লিক করার পর ক্যামেরা ওপেন হয়ে যাবে। ফেস স্কিনের সময় ফেসকে ডানে-বামে নাড়াবেন তাহলে ফেস স্কিন হয়ে যাবে এবং ‘Ok’ লেখা দেখাবে।
এখন আপনি আপনার ছবি দেখতে পারবেন এবং নিচের দিকে “এগিয়ে যান” বাটন রয়েছে সেখানে ক্লিক করার পর পাসওয়ার্ড ও ইউজার নেম সেট করে সাবমিট করলে আপনার রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন হয়ে যাবে।
৭.লগ ইন: যদি ওয়েবসাইটে পূর্ব থেকেই একাউন্ট থাকে তবে ওয়েবসাইটে প্রবেশের পর নিচের দিকে “লগ ইন” অপশন দেখাবে সেখানে লগ ইন করার জন্য আপনার ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।
৮.জন্ম নিবন্ধন নাম্বার: আইডি লগইন এর পর ড্যাশবোর্ডে আপনি আপনার ছবি দেখতে পাবেন। ছবি নিচের দিকে “বিস্তারিত প্রফাইল” নামে একটি অপশন রয়েছে সেখানে ক্লিক করুন।
এবার আপনার সামনে আপনার প্রোফাইলে থাকা সমস্ত তথ্য চলে আসবে এবং নিচের দিকে জন্ম নিবন্ধন নাম্বার রয়েছে যা একটু ভালো করে খেয়াল করলেই পেয়ে যাবেন।
Read More:
পাসপোর্টের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন বের করা
যদি আপনার ডিজিটাল পাসপোর্টে থাকে তবে আপনি খুব সহজেই কয়েকটি পদক্ষেপ এর মাধ্যমে পাসপোর্ট দিয়ে জন্ম নিবন্ধন নাম্বার বের করতে পারবেন।
১.ওয়েবসাইট প্রবেশ: আমাদেরকে নিবন্ধন যাচাইয়ের জন্য ওয়েবসাইট ওপেন করতে হবে।
২.পাসপোর্ট নাম্বার প্রদান: ডিজিটাল পাসপোর্টে ১৭ ডিজিটের ব্যক্তিগত নং/Personal No (পুরাতন পাসপোর্ট এটি নাও থাকতে পারে) রয়েছে। এই নাম্বারটি ও জন্ম তারিখ লিখে সার্চ করলে আপনি বিভিন্ন তথ্য দেখতে পাবেন যার মধ্য থেকে আপনি আপনার জন্ম নিবন্ধন নাম্বার জেনে নিতে পারবেন।
অনলাইন জন্ম নিবন্ধন যাচাই কপি ডাউনলোড
জন্ম নিবন্ধন এর মূল কপি পাওয়ার আগ অব্দি আমরা সামরিক কাজের চালানোর জন্য হারিয়ে যাওয়া জন্ম নিবন্ধন সনদের অনলাইন কপি ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে পারি। কেননা একটি জন্ম নিবন্ধন থেকে শুধু জন্ম নিবন্ধন নাম্বার ও জন্ম তারিখের প্রয়োজন হয়ে থাকে। তাই আমরা অনলাইন কপি দিয়েই কাজ করে নিতে পারব।
আমরা ইতিমধ্যেই জেনে নিয়েছি কিভাবে জন্ম নিবন্ধন নাম্বার বের করতে হয়। এখন শুধু তিনটি সহজ ধাপ অনুসরণ করার মাধ্যমে আমরা একটি অনলাইন জন্ম নিবন্ধন যাচাই ডাউনলোড করে নিতে পারব।
ডাউনলোড করার নিয়ম:
- ওয়েবসাইট ভিজিট: অনলাইন জন্ম নিবন্ধন যাচাই কপি ডাউনলোড করার জন্য আমাদেরকে প্রথমে জেনে নিতে হবে আমাদের জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে আছে কিনা। সেই জন্য প্রথমে আমাদেরকে জন্ম সনদ ভেরিফিকেশন ওয়েবসাইটে ভিজিট করতে হবে।
- নিবন্ধন সার্চ: ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার পর আপনার জন্ম নিবন্ধন নাম্বার, তারিখ ও একটি যাচাই প্রশ্ন থাকবে যা দ্বারা মূলত আপনি মানুষ কিনা তা যাচাই করা হবে প্রশ্নের উত্তর লিখে ‘সার্চ’ বাটনে ক্লিক করুন। আপনার জন্ম নিবন্ধন যদি অনলাইন ভার্সন হয় তাহলে সাথে সাথে আপনার সকল ইনফরমেশন যেমন-নাম, পিতা-মাতার নাম, জন্ম নিবন্ধন নাম্বার, তারিখ ইত্যাদি দেখতে পাবেন।
- যাচাই কপি প্রিন্ট: এখন এই পেইজটি প্রিন্ট করার জন্য আপনাকে কম্পিউটারের “ctrl + P” বাটনে ক্লিক করতে হবে।আর পরবর্তীবে ব্যবহারের জন্য আপনি চাইলে pdf পরম্যাটে সেভ করে রাখতে পারেন।
উপরোক্ত ধাপগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করার মাধ্যমে আপনি আপনার অনলাইন জন্ম নিবন্ধন যাচাই কপি ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। এই অনলাইন কপি দিয়েই আপনি জন্ম নিবন্ধন পুনঃমুদ্রনের জন্য আবেদন করবেন।
জন্ম নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার আবেদন করার নিয়ম :
আপনি অনলাইন থেকে একটি জন্ম নিবন্ধনের কপি নিতে পারবেন তবে একদিন জন্ম সনদ ডাউনলোড করার অধিকার ব্যক্তিপর্যায়ে করো নেই। এটি শুধু নির্বন্ধক কার্যালয়ের কাছেই থাকে।
তাই জন্ম নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার জন্য আপনাকে নির্বন্ধক কার্যালয়ে গিয়ে আবেদন করতে হবে। তবে কারো কাছে যদি হারানো জন্ম নিবন্ধন এর ফটোকপি না থাকে বা জন্ম নিবন্ধন নাম্বার পেতে সক্ষম না হয় তবে কি করতে হবে চলেন তা জেনে নেয়–
১.নাম্বার প্রদান: হারিয়ে যাওয়া জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি বা অনলাইন যাচাই কপি দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে তাহলে কাজটি সহজে সম্পন্ন হয়ে যাবে। তবে যদি আপনার এনআইডি(NID) না থাকে এবং আপনি জন্ম নিবন্ধন নাম্বার খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন তবে আপনাকে সরাসরি কর্মকর্তার কাছ থেকেই যাবতীয় কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।
এজন্য যা যা করতে হবে তা হল–
- ব্যাক্তিগত তথ্য প্রদান: প্রত্যেক নিবন্ধিত কার্যালয় জন্ম নিবন্ধন এর ডাটাবেইজে জন্ম নিবন্ধন করেছে এমন ব্যক্তিদের সকল তথ্য সংরক্ষিত থাকে তাই তাদের কাছ থেকে আপনি আপনার নাম বা পিতা মাতার নাম নিয়ে সার্চ করে আপনার নিবন্ধন নম্বর অন্যান্য তথ্য খুঁজে পেয়ে যাতে পারেন।
- পরিবারের অন্য কারো জন্ম নিবন্ধন প্রদান: অনলাইনে জন্ম নিবন্ধনগুলোতে একই পরিবারের নিবন্ধন নম্বর গুলোর মধ্যে একটি যোগসূত্র থাকে। তাই আপনার বাবা-মা অথবা পরিবারের যে কোনো কারো জন্ম নিবন্ধন নিয়ে গেলে আপনার কাজটি সহজে হয়ে যাবে। তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে ব্যক্তি নিবন্ধন নিবেন সে ব্যক্তির নিবন্ধটি একই অফিস থেকে নিবন্ধন করা হয়েছে।
২. ফি প্রদান: একটি নতুন জন্ম নিবন্ধন সরকার নির্ধারিত ফি হচ্ছে ১০০টাকা তবে জন্ম নিবন্ধন পুনঃমুদ্রণের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। আপনাকে সকল কাগজের সাথে এই ফি জমা দিয়ে আবেদন সম্পন্ন করতে হবে।
আবেদন করা সম্পূর্ণ হয়ে গেলে এবার শুধু অপেক্ষা করবেন এবং মাঝে মাঝে খবর নিবেন।
বর্তমান সময়ের জন্য জন্ম নিবন্ধন আসলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টই যা প্রায় সব কাজে ব্যবহার হয় তাই সতর্কতার সহিত এটিকে সংরক্ষণ রাখার চেষ্টা করবেন।
আশাকরি উপরের আলোচনা থেকে আপনি জেনে নিতে পেরেছেন যদি জন্ম নিবন্ধন হারিয়ে যায় কি কি ধাপ সম্পূর্ণ করার মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন আবার ফিরে পেতে পারবেন।